অর্থনীতির জনক ইবনে খালদুন, মুসলিম বিজ্ঞানী-১

#মুসলিম_বিজ্ঞানী 


*পর্ব:১


______________________


#ইবনে_খালদুন:-----------------


আমরা সকলেই জানি যে এডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনক বলা হয়। কিন্তু অনেক স্কলাররা ইবনে খালদুনকে

অর্থনীতির জনক বলেছেন। কারণ তার এমন অনেক অর্থনীতির থিওরি রয়েছে যেগুলো অ্যাডাম স্মিথ

এবং রিকার্ডো এর অনেক আগেই তিনি উল্লেখ করেছিলেন।


ইবনে খালদুন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মুকাদ্দিমার জন্য অধিক পরিচিত। এই বই ১৭ শতকের উসমানীয় ইতিহাসবিদ

কাতিপ চেলেপি ও মোস্তফা নাইমাকে প্রভাবিত করে। তাঁরা উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন বিশ্লেষণ করার

ক্ষেত্রে এই বইয়ের তত্ত্বের সাহায্য গ্রহণ করেন। ১৯ শতকের ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই বইয়ের গুরুত্ব স্বীকার

করতেন এবং ইবনে খালদুনকে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করতেন।


*ইবনে খালদুন :


মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসকে কর্মনৈপূণ্যে এবংবহুমাত্রিক প্রতিভায় যারা গৌরবান্বিত করেছেন , ইবনে খালদুন

তাদেরই একজন। ফ্রান্স রোজেন্থাল কর্তৃক তার (ইবনে খালদুনের) বিশ্ব ইতিহাসের "ভূমিকা" (মুকাদ্দিমা )

ইংরেজিতে অনুদিত হওয়ায় বিদ্যাজাগতিক পাড়ায় তাকে নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয় ।


তাই এখানে এই মরণজয়ী দার্শনিকের জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।


*শৈশব


নাম তাঁর ওলীউদ্দীন আবু যায়েদ আব্দুর রহমান ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আল হাসান ইবনে মোহাম্মদ ইবনে

জাবির ইবনে মোহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন রহ. । তবে ওলীউদ্দীন তার উপাধি

এবং আবু যায়েদ তার উপনাম। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তিনি ইবনে খালদুন ( বা স্রেফ খালদুন) নামে পরিচিত ।


এই যশস্বী মনীষীর জন্ম ১৩৩২ (৭৩২ হি.) সালের মাহে রমজানের ২৭ ই মে , উত্তর আফ্রিকা এবং আন্দালুসিয়ার

অন্যতম স্বভ্রান্ত বনু খালদুনে পরিবারে । উত্তর আফ্রিকা এবং আন্দালুসিয়ার রাজনীতির চাবিকাঠি ছিল বনু খালদুন পরিবারের কব্জায়।


যারফলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ইবনে খালদুনের রক্তে উত্তরাধিকার সুত্রেই গাঁথা ছিল।


গবেষনায় দেখা যায় যে বনু খালদুনের আদি নিবাস ছিল আন্দালুসিয়ার সেভিলে । সেভিলে বনু খালদুনের

প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রচুর ছিল । উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে খালদুনের পূর্বপুরুষ কুরাইব ইবনে খালদুনের

বিদ্রোহর ক্ষমতা অন্তত তাই বলে ।


রাজা ফার্ডিন্যান্ড (৩য় ) এর রিকনকুইস্তা থেকে বাঁচতে ইবনে খালদুনের পূর্বসুরী হাসান ইবনে মুহাম্মদ

(খালদুনের পিতামহের পিতামহ) তিউনিসিয়ায় বসতি গড়ে১৩শ শতাব্দীতে।তবে কারো কারো মতে

বনু খালদুনের আদি নিবাস ছিল ইয়ামানে। যাদের বংশলতিকা পৌঁছেছে সাহাবী ওয়ালিদ ইবন হুজর রা. পর্যন্ত ।

কিন্তু মুশকিল হল, খোদ ইবনে খালদুনই এই অভিমত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ।


উত্তরাধিকার সূত্রে ইবনে খালদুনের পিতৃপুরুষের পেশা রাজনীতি হলেও তার পিতা মোহাম্মদ আবু বকর ,

রাজনীতির কন্টাকির্ণ পথ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন জ্ঞানার্জনের তপস্যায় । ১৩৪৮ সালের মহামারীতে

ইবনে খালদুনের পিতা মৃত্যু বরণ করেন।

তার পিতার জ্ঞান-সাধনার এই সৌরভ মৌ মৌ করে ছড়িয়ে পড়ল বনু খালদুন পরিবারে ।

মুসলিম বিশ্ব উপহার পেলো জগদ্বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন এবং তার অনুজ ,

আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়া ইবনে খালদুন । ইয়াহিয়া পরে ইতিহাসবিদ এবং প্রশাসক হিসেবে খ‍্যাতি লাভ করেন ।


# পড়ালেখার হাতেখড়ি


ইবনে খালদুন তার প্রাথমিক পাঠ নিজ গৃহেই সম্পন্ন করেন। তার পিতাই ছিলেন খালদুনের প্রথম শিক্ষক।


অল্প বয়সেই কোরআন হিফজ করেন। এবং কোরআন তিলাওয়াতের নানাভঙ্গী রপ্ত করেন

উস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে সাদ ইবনে বোর্রালের কাছে ।উত্তর আফ্রিকা এবং আন্দালুসিয়ার

প্রধান ফিকহী মাযহাব মালিকী হওয়ায় , এই বিষয়ও তিনি রপ্ত করেন।


উপরন্তু হাদীসশাস্ত্রে পাঠগ্রহণ বুৎপত্তি অর্জন করেন।

১৩৪৭ সালে মারিনী সুলতান আবুল হাসান উত্তর আফ্রিকা ( মাগরেব) জয় করলে ,

তিউনিসিয়ায় অনেক বিদগ্ধ ফকীহ এবং মুহাদ্দিসের আগমন ঘটে । এই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়ে

তখন তিনি অনেকের কাছ থেকেই উভয় শাস্ত্রে ( ফিকহ এবং হাদীস ) "ইযাজা" গ্রহণ করেন ।


ইবনে খালদুন তার আত্মজীবনীতে লিখছেন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে

অধ‍্যয়ন করছেন এবং তার পরিবারের সব বিখ্যাত জ্ঞানতাপসদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করছেন ।

কিন্তু ১৩৪৮ সালের প্লেগ তার এই জ্ঞানসাধনার যাত্রাকে অনেকটা থমকে দেয়।


কেননা মহামারীর ধাক্কায় ইবনে খালদুনের শিক্ষকদের বড় একটা অংশ মৃত্যুবরণ করেন এবং

বাকিরা তিউনিসিয়া ছেড়ে চলে যান । এর মধ্য দিয়ে ইবনে খালদুনের আনুষ্ঠানিক

পড়াশোনার সাময়িক সমাপ্তি ঘটে।

অনেক জ্ঞানী,গুণী এবং প্রখ্যাত শায়খদের কাছে ইবনে খালদুন পাঠগ্রহণ করলেও ,

আন্দালুসিয়ার শিক্ষকদের প্রতি তার একধরনের গভীর টান ছিল।


#. রাজনীতির মারপ্যাচে :


১৪ শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকার রাজনীতি ছিল আগ্নেয়গিরির ন্যায় উত্তপ্ত । মরক্কো, আলজেরিয়া কিংবা

তিউনিসিয়া , কোথাও একটু স্বস্তি ছিল না।


এই রাজনৈতিক প্রলয়ের মধ্যেই ইবনে খালদুন সিলমোহর কারি পদে তিউনিসিয়ার রাজদরবারে চাকরি নিলেন ।


হাফসী বংশের তৎকালীন শাসক আবু ইসহাক হলেও, ক্ষমতার কলকাঠি নাড়তেন ইবনে তাফরেগীন।

তিনিই ইবনে খালদুনকে উক্ত পদে নিয়োগ দেন ।


১৩৫৪ সালে খালদুনের ভাগ্য তাকে নিয়ে এল মরক্কোর রাজ দরবার "ফেযে" । সুলতানের জ্ঞানসভায়

তিনি জায়গা করে নিলেন । যেখানে পূর্ব থেকেই আন্দালুসিয়া এবং মাগরেবের মনীষীগণ জ্ঞানযজ্ঞের

সাধনায় রত ছিলেন ।


নানাপক্ষীয় শাসকদের সঙ্গে ইবনে খালদুনের সখ্য গড়ে ওঠলে তিনি তৎকালীন মরক্কোর শাসক

আবু ইনানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত বুজির শাসক মোহাম্মদকে পালাতে সাহায্য করেন । এই সাহায্যের কথা

জানতে পেরে সুলতান ইবনে খালদুনকে কারাবন্দী করেন ।


তবে সুলতানের মৃত্যুতে কিছুকাল পরই কারাগার থেকে

তিনি মুক্তি পেয়ে১৩৫৮ সালে স্বপদে ফিরে আসেন ।

কিন্তু এরই মাঝে একটা উটকো ঝামেলা ইবনে খালদুনকে ঝাপটে ধরলো । সুলতান আবু ইনানের নির্বাসিত ভাই,

আবু সালিম নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন । তিনি ইবনে খালদুনের সহযোগিতা চাইলে , ইবনে খালদুন না

করতে পারলেন না । ইবনে খালদুনের সহযোগিতায় সিংহাসনে আরোহণ করলেন আবু সালিম ।


ইবনে খালদুন তার প্রধান রাজনৈতিক সচিবে পরিণত হন ।

উপরন্তু এর দু-বছর পর বিচারক পদও লাভ করেন , যা "মাজালিম" নামে প্রসিদ্ধ ছিল । তবে সুলতানের মৃত্যুর

পর ইবনে খালদুন গ্রানাডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । যা ছিল তৎকালীন আন্দালুসিয়ায় মুসলমানদের ক্ষমতার

সর্বশেষ আশ্রয়স্থল।


গ্রানাডার রাজ দরবারে তিনি বেশ সমাদরের সাথেই থাকতে লাগলেন। সুলতান মোহাম্মদ (৫ম)

এবং বিখ্যাত কবি এবং উজির ইবনে আল খাতীব তাকে বেশ সমীহ করলেন । কেবল তাই নয়,

তারা তাকে দূত হিসেবে ক‍্যাস্টলের রাজা পেড্রোর কাছে শান্তিচুক্তির জন্য প্রেরণ করেছিলেন।


পেড্রোর রাজ দরবার ছিল সেভিলে , যা কিনা খালদুনের পূর্বপুরুষদের আদিনিবাস ।

পেড্রো খালদুনের প্রজ্ঞা এবং দূতিয়ালীতে অভিভূত হয়ে তাকে সেভিলে থেকে যাবার অনুরোধ জানাল ।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল যে, তার পূর্বপুরুষের বিষয়-সম্পত্তি কড়াগন্ডায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে ।

কিন্তু ইবনে খালদুন এমন লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে শান্তিচুক্তি শেষে গ্রানাডায় ফিরে আসেন ।


তবে গ্রানাডার দরবারে খালদুনের সুখ বেশিদিন স্থায়ী

হয়নি । সফল দূতিয়ালীর দরবারে তার জনপ্রিয়তা হৈ হৈ করে বাড়তে থাকায় এটা ইবন খাতীবকে ভাবিয়ে তুলে।

অনেকটা তার কারণেই খালদুনকে গ্রানাডার দরবার ছেড়ে আসতে হয় ।


১৩৬৫ সালে উত্তর আফ্রিকায় ফিরে এসে ইবনে খালদুন

আল মোআহিদ শাসক মোহাম্মদের দরবারে প্রধান উজিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।


এই পদটা তার কপালে বেশি দিন স্থায়ী হলনা।

অতঃপর তিনি বিস্কারাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান । এখানে কিছু দিন স্থায়ী হন, কিন্তু তিনি আন্দালুসিয়ায়

ফিরে যেতে চাইলে , সুলতান আব্দুল আজিজের সৈন্যদের হাতে বন্দী হন ।

এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানীয় গোত্রদের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহে খালদুন সুলতানকে সহযোগিতা করেন ।

অবাক করা ব্যাপার হলো আর সব গুণের মধ্যে মহামতি ইবনে খালদুন এই কাজেও ষোলোকলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন

উত্তর আফ্রিকার নগর থেকে দূরে থাকা বেদুঈন গোত্রদের সঙ্গে খালদুনের ছিল বিশেষ সখ্য ।


মূলত তাদের স্বচ্ছ নীতি-নৈতিকতার জন্য ইবনে খালদুন তাদের বিশেষ সমীহ করতেন ।

তার "আসাবিয়া" তত্ত্বেও এর বিশেষ ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।


অবশেষে সুলতানের মৃত্যুর পর ইবনে খালদুন আন্দালুসিয়া গমন করেন । কিন্তু ইবনে খালদুন পূর্বের মতো

সুলতান মোহাম্মদ বিন আহমারের কাছে সমাদৃত না হলে তিনি উত্তর আফ্রিকায় ফিরে আসেন ।

এইবার তিনি তিলমিসানের ( আলজেরিয়া) সুলতান আবু হাম্মুর বিশেষ কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন

করতে থাকেন । আর পরিবার নিয়ে বনু আরিফের বিখ্যাত দূর্গ কালাত ইবনে সালামায় বসবাস করতে থাকেন।


# কপালে ☮️ শান্তি এলো বলে;

রাজনীতির উত্তপ্ত সমীরণে খালদুন যেন প্রায়ই হাপিয়ে ওঠেছেন । ভাবছেন অবশেষে বুঝি ছুটি জানানোর

সময় এসেছে ।


তাই খানিকটা নির্জনতার আঙ্গিনায় খালদুন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম (আল মুকাদ্দিমা) রচনা সম্পন্নে মন-প্রাণ

উজাড় করে দিলেন । কালাত ইবনে সালামার বিজন বাতাবরণে শুরু হল ইবনে খালদুনের জীবনের ৩য় পর্ব ।

ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক জীবনের আগুনতাতা অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি ইতিহাসের নিহিতার্থ আবিষ্কারের চেষ্টা

করলেন এবং সফলও হলেন । প্রথাবিরোধী পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্মাণ করলেন ইতিহাস-দর্শনের পথরেখা ।

এরই সূত্র-সন্ধান পাই আমরা তার আল-মুকাদ্দিমার ছত্রে ছত্রে ।


আল-মুকাদ্দিমা ১৩৭৭ সালের মধ্যে শেষ হলেও , মূলগ্রন্থ "কিতাবুল ইবার" লেখা শেষ করেন ১৩৮১সালে।


এরপর তিনি তার জন্মভূমি তিউনিসিয়ায় ফিরে আসার আবেদন করেন তৎকালীন সুলতান আবুল আব্বাসকে ।

ফিরে এসে আল-মুকাদ্দিমার সূত্রসমূহ যাচাই করে এর রচনা সম্পন্ন করেন । পুরো গ্রন্থটি শেষ হলে

তিনি একটি দীর্ঘ কবিতার মাধ্যমে সুলতানকে তা উৎসর্গ করেন ।


তবে রাজনীতির চোরাবালি থেকে নিষ্কৃতি পেতে ইবনে খালদুন সুলতানের কাছে হজ্জব্রত পালনের আবেদন

প্রকাশ করেন । সেই উপলক্ষ্যে তিনি ১৩৮২ সালে তিউনিসিয়া ত‍্যাগ করেন যেখানে তিনি আর কখনোই

ফিরে যাননি । অতপর পৌঁছালেন মিশরের রাজধানী কায়রোতে ।


মিশরে খালদুনের এটি পহেলা সফর হলেও এরই মধ্যে তিনি তার জগদ্বিখ্যাত মুকাদ্দিমার বদৌলতে পরিচিত

হয়ে ওঠেছিলেন । তাই মিশরের সুলতান জাহির আর বারকুক তাকে মালিকী মাযহাবের প্রধান বিচারিক পদ

অলংকৃত করতে অনুরোধ করেন । তবে এই ধরনের প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক পদে ইবনে খালদুনের

বিশেষ আগ্রহ ছিল না ; বিশেষত তৎকালীন দুর্নীতিগ্রস্থ ব‍্যবস্থার কারণে । উপরন্তু প্রশাসনিক সততার কারণে

এরই মধ্যে তিনি অনেক ক্ষমতাশালীদের চক্ষুশূলে পরিণত হন । ফলে বারবার তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতে থাকে ।

এর বিরূপ প্রভাব আমরা তার বিচারিক জীবনের শেষতক দেখতে পাই । রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে

প্রায় পাঁচবার তিনি পদচ‍্যুত হয়েছেন ।


এইসব ঘনঘটার মাঝে ইবনে খালদুন ১৩৮৮ সালে হজ্জব্রত পালন করেন । তাহির আল বারকুকের অস্থির

শাসনামলে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল আমির তৈমুরের সিরিয়া আক্রমণ । এবং ইবনে খালদুনের সাথে

আমির তাইমুর গুরিয়ানের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ (১৪০১) ।

কেউ কেউ একে গ‍্যাটের সাথে নেপোলিয়নের সাক্ষাৎকে তুলনা করেন ।


এই সাক্ষাতে আমির তৈমুর ইবনে খালদুনকে বিশেষ সমীহ করেন তার পাণ্ডিত্যের কারণে ।

এবং তিনি উত্তর আফ্রিকার ভৌগোলিক ইতিহাস সম্পর্কেও খালদুনের কাছ থেকে ধারণা নেন ।

কেবল তাই নয়, তৈমুরের অনুরোধে তিনি উত্তর আফ্রিকার ইতিহাস নিয়ে একটি মনোগ্রাফ লিখে

তাকে উপহার দেন । কিন্তু এরই মধ্যে তৈমুরের হাতে দামেস্কের পতন হয় । দামেস্কের এমন অসহায়

পরাজয়ে বিপদে পড়লেন ইবনে খালদুনসহ মিশরীয় এবং সিরীয় পণ্ডিতগণ । ফলে খালদুন বরাবরই মতোই দক্ষ

কূটনীতিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন । তার অনুরোধে তৈমুর আটকে পড়া পণ্ডিত এবং

প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিরাপদ প্রস্থানের আবেদন মন্জুর করেন ।

এভাবে ইবনে খালদুন মিশরে ফিরে এলে বিচারপতির পদে পুনরায় আসীন হন । এ নিয়ে ছ'বারের মতো

তিনি এই পদে আসীন হন । অবশেষে ৮০৮ হিজরীর ২৬ শে রমজান (১৪০৬ খ্রি) , এই মহান মনীষী ইন্তেকাল

করেন । তাকে বাবে নাসেরের সুফীদের কবরস্থানে দাফন করা হয় ।


মিশরে ইবনে খালদুনের যাপিত জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বের

পাশাপাশি অধ্যাপনাও করেন । আল-আজহারসহ প্রায় চারটি মাদ্রাসায় তিনি হাদীস এবং ফিকহের দারস দেন ।

মাদরাসাগুলো হল, কৌমিয়া , জাহিরিয়া, আল-আজহার এবং সারগিতমিতশিয়া ।


# দৃষ্টি ভঙ্গি;

আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, ইবনে খালদুন ধ্রুপদী এবং আধুনিক বহু পণ্ডিতের সমালোচনায় পড়েছেন ।

এদের মধ্যে ইবনে হাজর আল-আসক্বালানী রহ এবং তার শিষ্য আস-সাখাভী রহ. প্রণিধানযোগ্য ।

তাছাড়া তার সময়ের মিশরের পণ্ডিতবর্গের একটা অংশও তাকে পছন্দ করেননি।


তার সমালোচনা করার কারণগুলো ছিল এই।


১- সমাজ বিষয়ে তার যে পদ্ধতি এটা ছিল তৎকালীন সমস্ত পন্ডিতদের প্রথাবিরোধী।

২- তার ইতিহাস-পদ্ধতি অতীতের প্রচলিত মুসলিম ইতিহাসবিদদের থেকে ব‍্যাপকভাবে ভিন্ন ছিল ।

যেখানে তিনি বিপুল তথ্যের সমাহারের চেয়ে , কোনো নির্দিষ্ট সমাজের কার্যকারণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন ।

ইতিহাস এবং মানবসমাজ সম্পর্কে তার এই ব‍্যতিক্রমী এবং প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক হাদীস বিশারদের

মনপূত হয়নি ; ইবনে হাজর আল-আসক্বালানি (র.) এর অভিমতে যেন আমরা তারই প্রতিফলন দেখি ।


৬. ইবনে খালদুনের রচনা;

সংখ্যার বিচারে ইবনে খালদুনের রচনা খুবই কম।

কিন্তু সামান্য যা লিখেছেন তা গুণবিচারে অবিঃস্বরণীয় ।


তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা হচ্ছে "কিতাবুল ইবার" ; যা মূলত সাতখণ্ডে বিভক্ত ।

তিনি এই পুরো গ্রন্থকে তিনটি অধ্যায়ে বিন‍্যস্থ করেন।

১ম অধ্যায় , "মুকাদ্দিমা" ১ম খণ্ড নিয়ে ;

২য় অধ্যায়ে ২-৫ খণ্ড নিয়ে

৩য় অধ্যায় ৬-৭ খণ্ড নিয়ে গ্রন্থিত ।


তবে এই গ্রন্থের শেষে ইবনে খালদুনের যে আত্মজীবনী , "আত-তারিফ বি-ইবনে খালদুন" , তা জুড়ে দেওয়া

আছে । সুতরাং একে পৃথক রচনা হিসেবে ধরা হয় না।


তার আরো দুটি রচনা হল , লুবাবুল মুহাসসাল ফি উলুমিদ্দীন এবং শিফাউস সায়িল । প্রথমটি মূলত

ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী রহ. এর একটি গ্রন্থের ব‍্যাখ‍্যা এবং দ্বিতীয়টি একটা সুফীবিষয়ক রচনা ।


এগুলো ছাড়াও আরো পাঁচটি রচনা ইবনে খালদুনের বলে জানা যায় । কিন্তু সেগুলোর নাম ব‍্যতীত

কোনো হদিস পাওয়া যায়নি । যথা :

১. কাসিদায়ে বুরদার ব‍্যাখ‍্যাগ্রন্থ

২. যুক্তিবিদ্যার রূপরেখা

৩. পাটিগণিতের স্বরূপ (হিসাবশাস্ত্র)

৪. ইবনে রুশদের রচনাবলীর পর্যালোচনা

৫. ইবনে খাতীবের একটি কবিতার ব্যাখ্যা ।


মোদ্দাকথা :


ইবনে খালদুনের এই মোখতাছার জীবনী আমাদের এই ইঙ্গিত দিবে যে, তত্ত্বের সঙ্গে তাত্ত্বিকের যাপিত

জীবনের এক আবশ্যিক ঘনিষ্ঠতা আছে । যদিও আমরা এখানে খালদুনীয় ব‍্যবস্থা এবং তার স্বরূপ নিয়ে

আলাপ করিনি । কিন্তু তার "আসাবিয়া" এবং অন‍্যান্য তত্ত্বের সাথে পরিচিত যে কোনো বোদ্ধা পাঠকই

এই সেতুবন্ধনটা আঁচ করতে পারবেন ।


সূত্র নির্দেশ :


১. আল-মুকাদ্দিমা, গোলাম সামদানী কোরায়শী অনুদিত, ২০১৯, দিব‍্যপ্রকাশ

২. Ibn Khaldun : An Intellectual Biography, Robert Irwin, 2018, Princeton University Press

৩. Applying Ibn Khaldun, Syed Farid Alatas, 2014, Routledge

৪. উইকিপিডিয়া


#ইতিহাস_ও_তথ্য_সূত্র


Raqib Hussain

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন