#মুসলিম_বিজ্ঞানী:----------- 


*পর্ব:৩


__________________________


#জাবির_ইবনে_হাইয়ান:-----------


Chemistry বা রসায়নের পিছনে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরণীয়। 

Chemistry শব্দটি এসেছে Alchemy  থেকে। Alchemy শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ "আল-কিমিয়া " থেকে।Alchemy বহু আগে থেকে চর্চা করা হচ্ছে। কিন্তু সর্বপ্রথম যিনি এটাকে রসায়নে রূপ দেন,তাঁর নাম-

" জাবির ইবনে হাইয়ান "।


তাঁকে রসায়নবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

তিনি সর্বপ্রথম ব্যবহারিক এবং পরীক্ষামূলকভাবে রসায়নের চর্চা আরম্ভ করেন। শুধু তাই নয়, তিনিই সর্বপ্রথম Distillation বা পাতনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। 

ভেবে দেখুন, আজ এই পদ্ধতির মাধ্যমে নানা রকম  তেল,গ্যাসোলিন, অ্যালকোহল,সুগন্ধি ইত্যাদি প্রস্তুত করা হয়- আর এ পদ্ধতির উন্নতি ঘটিয়েছিলেন মুসলিম 

বিজ্ঞানী গণ। 


তাছাড়া, জাবির ইবনে হাইয়ান Nitric Acid উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি সালফিউরিক এসিড প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন এবং লবণ হতে Hydrochloric Acid প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন Aqua Regia ,যার মাধ্যমে সোনা গলানো যায়। 

জাবির ইবনে হাইয়ান Distillation ( পাতন), filteration (ছাঁকন), বাষ্পীভবন, oxidation, স্ফটিককরণ ইত্যাদি আবিষ্কারে অবদান রেখেছিলেন। বর্তমানে এই পদ্ধতিগুলো  ব্যবহার করে গোলাপ জল, আতর,সাবান, ঔষধ সহ নানা ধরনের দ্রব্যাদি তৈরি করা হচ্ছে। 


*প্রারম্ভিকা:


আবু মুসা জাবির ইবন হাইয়ান (আল-বারিজি / আল-আযদি / আল-কুফি / আল-তুসি / আল-সুফি, আরবি: جابر بن حیان‎‎, ফার্সি: جابرحیان) (জন্ম:৭২১ - মৃত্যু:৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ)বিখ্যাত শিয়া মুসলিম বহুশাস্ত্রজ্ঞ। পাশ্চাত্য বিশ্বে তিনি জেবার নামে পরিচিত যা তার নামের লাতিন সংস্করণ। তিনি ছিলেন একাধারে রসায়নবিদ ও আলকেমিবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষী, প্রকৌশলী, দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী এবং ঔষধ বিশারদ ও চিকিৎসক। তাকে "রসায়নের জনক" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জাবির ইবন হাইয়ান আলকেমিতে পরীক্ষণমূলক পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেছিলেন।


*জন্ম ও শৈশবকাল:


জাবির ইবন হাইয়ান ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের তুস নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। 


কিছু সূত্রে জানা যায় যে, তার পিতার নাম ছিল  হাইয়ান আল-আযদি।তিনি ছিলেন আরবীয় আজদি গোত্রের লোক। আরবের দক্ষিণাংশে জাবিরের পূর্ব পুরুষগণ বাস করতেন। স্থানীয় রাজনীতিতে আজাদি গোত্র সক্রিয়ভবে জড়িত ছিল। পরবর্তীতে জাবিরের পিতা হাইয়ান আল-আজদি আগের বাসস্থান ত্যাগ করে কুফায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতা। 


উমাইয়া বংশের খলিফাদের নিষ্ঠুর ও অমানবিক কার্যকলাপে হাইয়ান আল-আজাদি তাদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতেন। উমাইয়া শাসন উৎখাতে তিনি পারস্যের কয়েকটি প্রভাবশালী বংশের সঙ্গে পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করার জন্য আব্বাসীয়দের দূত হিসাবে ইরানের খোরাসান প্রদেশের তুস নগরীতে গমন করেন। এ তুস নগরীতেই ৭২১ সালে বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ানের জন্ম।

হাইয়ান আল-আজাদির ষড়যন্ত্রের কথা দ্রুত তৎকালীন খলিফার দৃষ্টিগোচর হয়।


 খলিফা তাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তার পরিবার পরিজনদের পুনরায় দক্ষিণ আরবে প্রেরণ করেন। দক্ষিণ আরবেই জাবির ইবনে হাইয়ান শিক্ষা লাভ করেন। হারবি আল-হিমারি ছিলেন তার শিক্ষক। তার কাছে তিনি হিমারি ভাষা ছাড়াও কোরআন, গণিত ও অন্যান্য বিজ্ঞান অধ্যায়ন করেন। শিক্ষা লাভের প্রতি ছিল তার পরম আগ্রহ। পিতার পেশা আলকেমি রসায়নের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টিতে বিরাট অবদান রাখে। একজন সন্ন্যাসির কাছে তিনি আলকেমির পাঠ গ্রহণ করেন। যে কোন বিষয়ের বই পেলে তিনি তা পড়ে শেষ করে ফেলতেন এবং তার ওপর গবেষণা চালাতেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এখানে গণিতের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। শিক্ষা গ্রহণ শেষ হওয়ার পর জাবির ইবনে হাইয়ান পিতার কর্মস্থল কুফা নগরীতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি প্রথমে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন এবং এ সূত্রেই তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত শিয়াদের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।


*রাজদরবারের সঙ্গে জাবিরের যোগাযোগঃ 


খালিদ ইবনে বারমাকের নেতৃত্বে বারমাকী পরিবার ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের সমর্থক। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের আমলে খালিদ ইবনে বারমাক মেসোপটেমিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হন। একবার গভর্নর খালিদের সুন্দরী দাসী মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসকগণ তার চিকিৎসা করে ব্যর্থ হন। 


এ সময় ডাক পড়ে জাবির ইবনে হাইয়ানের। জাবির মাত্র কয়েক দিনের চিকিৎসায় তাকে সুস্থ করে তোলেন। এতে গভর্নর খালিদ খুব সন্তুষ্ট হন এবং জাবিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর মধ্যস্থতায় তিনি রাষ্ট্রীয় কিছু সুযোগ সুবিধা লাভ করেন। তাতে তিনি রসায়ন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করার সুযোগ পান। মন্ত্রী ইয়াহিয়া এবং তার পুত্র জাবিরের নিকট রসায়ন বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ রসায়ন বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হন। জাবির ইবনে হাইয়ান প্রতিটি বিষয়ই যুক্তির সাহায্যে বুঝার ও অনুধাবন করার চেষ্টা করতেন। প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার ফলাফল লিখে রাখতেন। ৮০৩ সালে বারমাকীদের পতন ঘটলে জাবির ইবনে হাইয়ান বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হন। তারপর তাকে কুফায় গৃহবন্দি করা হয়।


 জাবিরের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারঃ


জাবিরকে পরশ পাথরের মোহ পেয়ে বসেছিল। তবে তিনি বৈজ্ঞানিক উপায়ে চেষ্টা করেছেন। কোন কোন সূত্র দাবি করছে, তিনি তার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন। জাবির এলিক্সারের ‍গুণাবলী ও কার্যপ্রণালী বর্ণনা করলেও জিনিসটি দেখতে কেমন তিনি তার আভাস দেননি। আরবীতে নাইট্রিক (Nitric) শব্দটিকে বলা হতো ‘নাট্রন’। জাবির ‘কিতাবুল ইসতিতমাম’ - এর ২৩ তম অধ্যায়ে নাইট্রিক এসিড প্রস্তুত করার ফর্মুলা বর্ণনা করেছেন। নাইট্রিক এসিড দিয়ে স্বর্ণ গলানোর ফর্মুলা এবং এসিড দিয়ে স্বর্ণ থেকে রৌপ পৃথক করার প্রণালী তিনিই আবিষ্কার করেন। সোনা একটি রাসায়নিক উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু বিশুদ্ধ অবস্থায় সোনা পাওয়া যেত না। অন্য ধাতুর সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় পাওয়া যেত। মিশ্রিত ধাতু থেকে সোনা পৃথকীকরণের কৌশল জাবিরের আগে অন্য কেউ বের করতে পারেননি। তিনিই প্রথম সীসার সঙ্গে মিশিয়ে সোনা বিশুদ্ধ করার উপায় খুঁজে বের করেন। এ উপায়কে বলা হতো ‘কুপেলেশন’ (Cupellation) প্রণালী।

জাবিরই সর্বপ্রথম দেখান যে, সিলভার নাইট্রেট দ্রবণের সঙ্গে সাধারণ লবণ যোগ করলে একটি ঘোলাটে অধঃক্ষেপ প্রস্তুত হয়। তা থেকে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌছান যে, এভাবে রাসায়নিক যৌগিক পদার্থে বিদ্যমান রৌপ্যের অস্তিত্ব নিরূপণ করা সম্ভব।


 নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম ‘একোয়া রিজিয়া’ (Aqua Regia)। এ নামটি জাবিরের দেয়া। উপাদানটি স্বর্ণকে দ্রবীভূত করতে পারে। পাতন, উর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভস্মীকরণ, গলন, বাষ্পীভবন ইত্যাদি রাসায়নিক সংশ্লেষণ এবং তার ফলাফল তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। জাবির কস্টিক সোডা, চামড়া ও কাপড়ে রং করার প্রণালী, লোহা, ওয়াটারপ্রুফ কাপড়, বার্ণিশ করার উপায়, সোনার পানিতে পুস্তকে নাম লেখার জন্য লোহার ব্যবহার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। এলেমবিক ও বিশেষ ধরনের কাঁচের পাত্রসহ আধুনিক গবেষণাগারে ব্যবহৃত অন্তত ২০ টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কারক হলেন তিনি। ‘এলেমবিক’ নামটি তার দেয়া। এলেমবিকের অংশ হিসাবে পাতনের জন্য তিনি বকযন্ত্র আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে মুসলিম বিজ্ঞানীরা তার যন্ত্রটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন এবং ১৫৭০ সালে এ যন্ত্র ইউরোপে চালু করা হয়। ইমাম জাফর আল-সাদিকের আগ্রহে সাড়া দিয়ে জাবির আগুন প্রতিরোধ সক্ষম বিশেষ ধরণের কাগজ প্রস্তুত করেছিলেন। বিশেষ ধরণের একটি কালিও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। এ কালির লেখা রাতের অন্ধকারে পাঠ করা যেতো। তামার যে কোনো যৌগিক পদার্থ আগুনের শিখায় উজ্জ্বল নীল আলো বিকিরণ করে। জাবির তামার এ বিশেষ গুণের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।


তামার এ গুণ ব্যবহার করে তিনি উল্লেখিত কালি তৈরি করেছিলেন। নাইট্রিক এসিড সংশ্লিষ্ট কয়েকটি যৌগিক পদার্থও তিনি প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব যৌগিক পদার্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিলভার নাইট্রেট ও মারকিউরিক ক্লোরাইড। জাবির প্রথম পাতন প্রণালীর মধ্য দিয়ে ভিনিগার থেকে এসিটিক এসিড ঘনীভূত করেছিলেন। রৌপ্যের সঙ্গে নাইট্রিক এডিসের সংমিশ্রণে উৎপন্ন যৌগিক পদার্থের নাম সিলভার নাইট্রেট। পারদের সঙ্গে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সংমিশ্রণে উৎপন্ন হয় মারকিউরিক ক্লোরাইড। জাবিরের বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করলে জানা যায়, তিনি সালাফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরাইড এসিড প্রস্তুত করেছিলেন এবং এসিডের নাম দিয়েছিলেন ‘আলযাজাজ তেল’। জাবির গন্ধককে ক্ষারের সঙ্গে তাপ দিয়ে লিভার অব সালফর এবং মিল্ক অব সালফার তৈরি করেছিলেন। তিনি বিশুদ্ধ ভিট্রিওল, এলামস, আলকালি, নিশাদল, সল্টপিটার, লীড এসিটেট, বিষাক্ত অক্সাইড-ও প্রস্তুত করেছিলেন। অন্য ধাতুর সঙ্গে মিশ্র স্বর্ণকে মীগারের সঙ্গে মিশিয়ে স্বর্ণ বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি তিনিই আবিষ্কার করেন। তিনি রঞ্জক ও অন্যান্য পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণে তার অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে রঙ্গীন কাঁচ তৈরির ৪৬ টি মৌলিক প্রণালীর বর্ণনা দিয়েছেন। আর্সেনিক ও এন্টিমনি কিভাবে প্রস্তুত করা যায় এবং ধাতু কিভাবে বিশুদ্ধ করতে হয় তিনি তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জাবির প্রথম স্বর্ণ, রৌপ্য, টিন, সীসা, পারদ, লোহা ও তামা - এ ৭ টি ধাতুকে শ্রেণীকরণ করেন। তিনি তার ‘কিতাব আল-দুরা আল-মাকনুনা’য় (The Book of the Hidden Peral) প্রথম কৃত্রিম মুক্তা ও মূল্যবান রত্ন উৎপাদন এবং বিবর্ণ মুক্তা পরিশোধন প্রণালী বর্ণনা করেছেন। একই বইয়ে তিনি পনির থেকে সিরিশ তৈরির বর্ণনা দিয়েছেন। জাবির বর্ম (জাওরাসিন), শিরোস্ত্রান (বিদ) ও ঢাল (দারাক) হিসাবে ব্যবহারের জন্য প্লেটযুক্ত শক্ত আচ্ছাদন উদ্ভাবন করেন। জাবির প্রসাধন শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উদ্ভিদ থেকে সংগৃহীত সুগন্ধি দিয়ে তিনি প্রসাধনী তৈরি করতেন। জাবিরের এসব আবিষ্কার আধুনিক রসায়নের ভিত্তি হিসাবে কাজ করছে।

গবেষণাগারে ‘তাকউইন’ বা কৃত্রিম জীবন সৃষ্টি করা ছিল আলকেমি নিয়ে জাবিরের গবেষণার লক্ষ্য। তার গবেষণাগারে বৃশ্চিক, সাপ এমনকি মানুষের মতো প্রাণী সৃষ্টির রেসিপি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়। জাবির এসব রেসিপি দিয়ে কী করতে চেয়েছিলেন তা অস্পষ্ট। আলকেমি নিয়ে তার গবেষণার ভিত্তি ছিল গিথাগোরাসীয় ও নব্য প্লেটোবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিউমারলোজি। তিনি আরবী বর্ণমালার সংখ্যার মানের সাহায্যে পদার্থের প্রকৃতি ও গুণের সংজ্ঞা দিতেন।

উষ্ণ পানীয় বা ওয়াইন সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল। আরবী ‘আল-কোহল’ থেকে ‘এলকোহল’ শব্দটি এসেছে। এলকোহল হলো ওয়াইন বা মদ তৈরির উপাদান। ‘কিতাব আল-তারাফুক ফি আল-আতর’ (দ্যা বুক অব দ্যা কেমিস্ট্রি অব পারফিউম) - এ জাবির ওয়াইন পাতনের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘কিতাব ইখরাজ মাফি আল-ফিল’ - এ তিনি বিশ্বে প্রথম এলকোহলের বর্ণনা দেন। ইসলামে মদ পান নিষিদ্ধ হলেও ওষুধ, রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্পে ওয়াইন ব্যবহার করা হতো। আরব বিশ্বে বসবাসকারী অমুসলিমরা মদ পান করতো। মদ প্রস্তুতে জাবিরের অবদান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মুসলিম বিজ্ঞান লেখক আহমদ ওয়াই হাসান লিখেছেন, ‘The distillation of wine and the properties of alcohol were known to Islamic chemists from the eight century. The prohibition of wine in Islam did not mean that wine was not produced or consumed or that Arab alchemists did not subject it to their distillation processes. Jabir Ibn Hayyan described a cooling technique which can be applied to distillation of alcohol.’

অর্থাৎ ‘অষ্টম শতাব্দী থেকে মুসলিম আলকেমিস্টরা মদ ও এলকোহলের ধর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ইসলামে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার মানে এই নয় যে, মদ তৈরি অথবা পান করা হতো না কিংবা আরব আলকেমিস্টরা তাদের পাতন প্রক্রিয়ায় তা ব্যবহার করতেন না। জাবির ইবনে হাইয়ান একটি শীতলীকরণ কৌশলের বর্ণনা দিয়েছিলেন যা এলকোহল পাতনে প্রয়োগ করা যেতো।’


জাবিরের বইয়ের পরিচয় নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টিঃ


জাবিরের জন্ম তারিখ নিয়ে গোলমাল দেখা দেয়ায় ল্যাটিন ভাষায় তার অনূদিত বইগুলোর পরিচয় নিয়ে বিভ্রাট ঘটে। সন্দেহবাদীদের একদলে রয়েছেন জার্মান পণ্ডিত জে.রুসকা ও পল ক্লাউস। অন্য দলে রয়েছেন ইংরেজ পণ্ডিত ই.জে. হোমইয়ার্ড ও গণিতের ঐতিহাসিক জি. সারটন। উভয়দলই জাবিরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন এবং তিনি রসায়ন শাস্ত্রর ওপর প্রচুর বই লিখেছেন বলে স্বীকার করছেন। প্রথম দলের মতে, জাবির অষ্টম শতাব্দীর লোক নন। আর যদি অষ্টম শতাব্দীর লোক হয়েও থাকেন তাহলেও তার নামে যেসব বই পুস্তক দেখা যায় সেগুলোর সব তার লিখা নয়। দ্বিতীয় দলের মতে, জাবির অষ্টম শতাব্দীর লোক। গ্রন্থগুলো তার নিজের এবং প্রকৃতপক্ষে তিনি আধুনিক রসায়নের জন্মদাতা।


জাবিরের জন্ম তারিখ নিয়ে বিভ্রাট ছাড়া আরো দু’টি কারণে এ মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। একটি কারণ হলো মুসলিম পণ্ডিত ইবনে নাদিমের অভিমত এবং দ্বিতীয় কারণটি হলো ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত ৫ টি বইয়ের মূল আরবী কপির অপ্রাপ্যতা। এ ৫ টি বই হলোঃ

   

  (১) লাইবার (জিবারি) দ্যা ট্রান্সমিউটেশনি মেটালোরাম

     (২) দ্যা ইনভেস্টিগেশনি পারফেকশনিস

     (৩) দ্যা ইনভেনশনি ভেরিটাটিস

     (৪) লাইবার ফোরনাকাম

     (৫) টেসরামেন্টাম জিবারি


ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে আলোচিত বইগুলো সম্পর্কে কেউ কোন উল্লেখ করেননি। ইবেন খাল্লিকান ও হাজী খলিফাও মূল আরবী গ্রন্থের কোনো উল্লেখ করেননি। এখান থেকে বইগুেলোর পরিচয় নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধে। উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিজ্ঞানী হেরম্যান কোপ প্রথম সন্দেহ ঢোকান। তিনি জার্মান রসায়নবিদ গুস্তাভ বাইলের সহায়তায় কথিত ‘জিবার’ ও জাবির ইবনে হাইয়ানের জ্ঞাত সব তথ্য সংগ্রহ করেন। হেরম্যান কোপ এবং গুস্তাভ বাইল উভয়ে ছিলেন আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ। ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত অনুবাদের ওপর ভিত্তি করে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, জিবারে নামে প্রচলিত সবগুলো বই জাবিরের কিনা তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তারা ধারণা করেছিলেন যে, ‘জিবার’ ল্যাটিন এবং জাবির আরব। তাদের এ ধরণা মোটেও সাঠিক ছিল না। মঁসিয়ে বার্থেলট তার ‘লা চিমাই আউ মোয়েন এজ. - এ উল্লেখিত পণ্ডিতদের সন্দেহের প্রতি সায় দেন। বার্থেলট জাবিরের ৯ টি বই সম্পাদনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত গ্রন্থগুলো জাবিরের নয়।


জাবিরের প্রতি বার্থেলটের অবিচারের প্রতিবাদে গণিতজ্ঞ ই. জে. হোমইয়ার্ড ‘এ ক্রিটিক্যাল এক্সামিনেশন অব বার্থেলট ওয়ার্কস আপন এরাবিক কেমিস্ট্রি’ শিরোনামে এক গবেষণাধর্মী লেখায় বলেছেন, ‘Fortunately for chemistry, this man of genius nad unbounded energy was drawn towards natural sciences and encouraged by Imam Jafar al-Sadiq turned his attention to the study of the composition of substances obtained from minerals, plants and animals. His writings prove that this study meant to him not merely the reading of books but the close investigation of Nature and a stem discipline in the laboratory. It has to be said that Berthelot, having made up his mind-on what seem to be insufficient grounds-that the Latin Jaber is not to be indetified with the Arab Jaibr Ibn Hayyan, appears deliberately to underrate the latter; he cartainly gives an entirely false idea of Jabir's scientific ability.’

অর্থাৎ রসায়নের জন্য সৌভাগ্য যে, এই মেধাবী ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী লোকটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং ইমাম জাফর আল-সাদিকের উৎসাহে খনিজ, উদ্ভদ ও প্রাণী থেকে প্রাপ্ত উপাদানগুলোর গঠন অধ্যয়নে তার মনোযোগ নিবিষ্ট করেছিলেন। তার লেখালিখি থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, নিছক বই পাঠ করা তার অধ্যায়নের লক্ষ্য ছিল না বরং প্রকৃতির নিবিড় অনুসন্ধান এবং গবেষণাগারে কঠোর গবেষনা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বার্থেলট দৃশ্যত অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলেছেন, ল্যাটিন জিবারকে আরবি জাবির ইবেন হাইয়ানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। তাতে মনে হচ্ছে, তিনি উদ্দেশ্যমুলকভাবে তাকে খাটো করেছেন। তিনি জাবির ইবনে হাইয়ানের বৈজ্ঞানিক সামর্থ সম্পর্কে পুরোপুরি ভুল ধারণা দিচ্ছেন।


কথিত ল্যাটিন 'জিবার' ও জাবির একই ইবনে হাইয়ান যে প্রকৃত ব্যক্তি 'দ্যা ওয়ার্কস অব জি' শিরোনামে গ্রন্থে গণিত জ্ঞান হোম তা অকপটে আমাকে করেছেন। বইটির ১৭ নম্বর পাতায় তিনি লিখেছেন, 'সেরাটিন যে গেবার ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ, গাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়া আর কেউ নন এবং মধ্যযুগে গাবরীর কিছু বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।' শব্দ 'যে, জিবার ইসলামের শ্রেষ্ঠতম রসায়নবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়া আর কেউ একজন নান এবং মধ্যযুগে জাবিরের উদাহরণের বই ল্যাটিন শব্দ অনুবাদ করা হয়।'


জাবিরের রচনাবলীঃ


জাবির তিন হাজার গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা পেয়েছিলেন তার ফলাফলের বিবরণই ছিল তার বইয়ের বিষয়বস্তু।


 তার প্রণীত গ্রন্থের মধ্যে রসায়নে ২৬৭টি, যুদ্ধাস্ত্র বিষয়ক ৩০০টি, চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক ৫০০টি, দর্শনে ৩০০টি, জ্যেতি বিজ্ঞান বিষয়ক ৩০০টি, দার্শনিক যুগ খণ্ডন রচনায় আরো পাঁচ শত গ্রন্থ। তার গ্রন্থের লেখা আরও পছন্দের কোনটির পৃষ্ঠা সংখ্যা দুই সংকলন চারের বেশি নয়।


 অনেক বইগুলো

   (১) কিতাবু উসতু কাসিল উসিল আউয়াল ইলাম বারামিকা

   (২) কিতাবু উসতু কাসিল আসিস ছানি ইলাইহিম

   (৩) কিতাবুল কামালে হুয়াহু বছরেরছ ইলাইহিম

   (৪) কিতাবুল ওয়াহিদুল কাবির

   (৫) কিতাবুল ওয়াহিদিস সাগীর

   (৬) কিতাবুল রুকোনে

   (৭) কিতাবুল বাইয়ান

   (৮) কিতাবুল তারতীব

   (৯) কিতাবুল নূর

   (১০) কিতাবুস সিবগিল আহমার

   (১১) কিতাবুল খামাইরিস কাবির

   (১২) কিতাবুল তাদরবির রাইয়া

   (১৩) কিতাব ইউরাফু বিস ছালিস

   (১৪) কিতাবুর রুহ

   (১৫) কিতাবুয বাক


*মৃত্যু:

এ মনীষীর আলোচনা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোনো কথা বলা হয়, তিনি ৮০৩ কুফায় গৃহবন্দি মৃত্যুবরন করেন। হাজী খলিফার নিজের, তিনি ৭৭৬ সালে ইন্তেকাল করেছেন। হাজী খলিফা প্রদত্ত তার তারিখ তারিখ তার জন্ম তারিখের মতোই ভূল। সব বিষয় একজন প্রফেসর হোমায়্যার্ড এ আদেশে উল্লেখ করেছেন যে, জাবির খুব সম্ভব ৭৩০-বছর৩৫ এর মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন এবং ৮২৫ সালে ৮০ বছরের পুরনো এ নশ্বর বিশ্ব থেকে বিদায় গ্রহন করেন। প্রাধান্য সময় তার বালিশের নিচে 'কিতাব আল-রাহ'র একটি কপি পাওয়া উচিত।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন